রাজশাহী টাইমস ডেক্সঃ
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে বেসরকারি সংস্থা বা আইনি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের পর একটি অংশ ওই প্রতিষ্ঠানকে কমিশন হিসাবে দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। বিষয়টির আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে এবং আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনস্থ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) এবং সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে যেসব প্রবাসী বাংলাদেশি রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের অর্থের উৎস, পেশা, বাসস্থানের তথ্য সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশে নোট ভার্বাল ইস্যু করা হয়েছে। এ বিষয়ে মিশনগুলো তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে।
এছাড়াও মানিলন্ডারিং মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও অর্থপাচার প্রতিরোধে একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে ট্রেড বেজড মানিলন্ডারিং বা আমদানি, রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের সর্বশেষ (৭ম) সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিনের সভাপতিত্বে অ্যাটর্নি জেনারেলের সভাকক্ষে ওই সভা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, এনবিআর, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের শীর্ষ প্রতিনিধিরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় দেশ যখন ডলার সংকটে ভুগছে তখন টাকা পাচার ও পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি একটি প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় আশি হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। গত পাঁচ বছরে এভাবে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে৷
পাচার হওয়া টাকা নিয়ে কানাডায় গড়ে উঠেছে বেগমপাড়া। শুধু কানাডা নয়, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জসহ নানান দেশে বিপুল অর্থপাচার হয়েছে বলেও উঠে এসেছে গোয়েন্দাসহ নানা প্রতিবেদনে। অর্থপাচারে শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী জড়িত বলে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বার বার বলে আসছেন। যদিও পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে ‘উদ্যোগ’ নেওয়া ছাড়া বড় কোনো সাফল্য নেই।
ওই সভায় অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, অনেক দেশই পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে বেসরকারি সংস্থা ও আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে থাকে। উদ্ধারকৃত সম্পদের একটি অংশ নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে সম্মানি হিসেবে দিতে হয়। বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে জানানো হয়, এ পদ্ধতি অনুসরণ করে এর আগে দুদক বিদেশ থেকে পাচারের অর্থ দেশে ফেরত এনেছে।
জানা যায়, ‘অক্টোখান’ নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা হয়। এর বিনিময়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে উদ্ধারকৃত অর্থের ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে দেয় দুদক। ২০১৫ সালের পর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আর চুক্তি নবায়ন করা হয়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে পাচারকারী ও পাচার করা অর্থের তথ্য সংগ্রহের পর তালিকা ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষ মালামাল ছাড়করণের ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে তা বৃদ্ধিপূর্বক শুল্কায়ন করে থাকে। এ ধরনের অসামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে এনবিআরের বিদ্যমান উদ্যোগের পাশাপাশি মানিলন্ডারিং মামলা দায়েরে গুরুত্ব দিতে হবে।
সভায় দুদকের প্রতিনিধি জানান, এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের লক্ষ্যে ৩৪ টি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) প্রেরণ করেছে। যার মধ্যে মাত্র ২টি অনুরোধের বিষয়ে দুটি দেশ থেকে যোগাযোগ করা হলেও বাকি অনুরোধসমূহের বিষয়ে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, এমএলএআর প্রেরণের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইন্টারমিডিয়ারির ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনুরোধ স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুরোধকৃত রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিকট প্রেরণ করা হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে অনুরোধ প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সরাসরি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় তথ্য বা সংশোধনের বিষয়ে অনুরোধ করে থাকে। সরাসরি যোগাযোগের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ হাইকমিশন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ এ ধরনের যোগাযোগের বিষয়ে অবহিত থাকে না।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, অনেক সময় এমএলএআর পাঠানোর ক্ষেত্রে অনুরোধকৃত দেশ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অতিরিক্ত তথ্য ও সংশোধনের জন্য অনুরোধ করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে যাচিত তথ্য সরবরাহ করা না গেলে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তথ্য প্রাপ্তির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ তাদের নিজস্ব ভাষায় এমএলএআর প্রেরণের পরামর্শ দিয়ে থাকে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন তাদের ভাষায় অনুবাদ করে সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে থাকে। এসব কারণে এমএলএআর-এর মাধ্যমে যাচিত সাক্ষ্য-প্রমাণ পেতে বিলম্ব হয়।
তিনি দ্রুত তথ্য পাওয়ার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ কয়েকটি ভাষায় (ইংরেজি, আরবি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, জাপানি) অনুবাদের বিষয়ে মতামত প্রদান করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধি জানান, দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য ৬-৭ টি দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স (এমএলএ) কোন কোন দেশের সঙ্গে করা হবে তা অবহিত করার বিষয়ে বিএফআইইউকে অনুরোধ করা হয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএফআইইউ ১০টি দেশের (কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও হংকং-চায়না) সঙ্গে চুক্তি থাকা প্রয়োজন বলে জানায়। ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিংয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ বা সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে সভায় জানানো হয়।
যেসব প্রবাসী রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের অর্থের উৎস, পেশা, বাসস্থানের তথ্য সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশে নোট ভার্বাল ইস্যু করা হয়েছে। এ বিষয়ে মিশনগুলো তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে। নোট ভার্বালের পাশাপাশি মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হবে। এছাড়া কনভার্ট ওয়ে বা গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে বলে সভায় মত দেওয়া হয়।
সভায় কমিশনের মাধ্যমে পাচার করা টাকার ফেরত আনা, মানি লন্ডারিং এর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের সচেতন করার পদক্ষেপ নেওয়াসহ ১০টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে সরকারের এমন তোড়জোড় নতুন নয়। এর আগে করের বিনিময়ে পাচারের অর্থ ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিনা প্রশ্নে ৭ শতাংশ আয়কর দিয়ে অর্থ ফেরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যদিও তাতে সাড়া মেলেনি। এ কারণে চলতি অর্থবছরে সেই সুবিধা বাতিল করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবে অর্থপাচার রোধ করা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের রাজনৈতিক সমন্বয়ক ফরিদুল হক বলেন, বছরে কত টাকা পাচার হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা হিসাব কারও কাছে নাই। সরকার চায় না এ হিসাব থাকুক। তারা এসব পাচারের হিসাব এবং তথ্য-উপাত্ত সচেতনভাবে নষ্ট করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সরকারের এসব কাজের অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ আছে। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তদন্ত না করতে নির্দেশনা দেওয়া।
অর্থপাচারের একাধিক কারণ আছে উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। এরই মধ্যে টাকার মান কমে গেছে। বিত্তবানদের অনেকে বিদেশি মুদ্রায় নিজের সম্পদ রক্ষা করতে চাচ্ছে। আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তাদের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা জরুরি। এসবের জন্য তারা টাকা বিদেশে রাখতে চায়।