এসএম রুবেল,চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদে পবিত্র ইদুল ফিতর উপলক্ষে বরাদ্দ দেয়া ভিজিএফ’র চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় নাম থাকা অনেকেই পায়নি ভিজিএফ’র চাল। এমনকি নাম না থেকে চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের কাছের অনেক লোকজনই পেয়েছে ভিজিএফ’র চাল। এছাড়াও ১০ কেজির জায়গায় ৮-৯ কেজি করে দেয়া হয়েছে ভিজিএফ’র চাল।
জানা যায়,গোবরাতলা ইউনিয়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ৪২০০ কার্ডধারী পরিবারের মাঝে ৪২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। চলতি মাসের ১৬, ১৭ ও ১৮ এপ্রিল গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এসব চাল বিতরণ করা হয়।
মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) সকালে ও দুপুরে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়,দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে চালের অপেক্ষা করছেন সুবিধাভোগীরা। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেকে একটি কার্ডের বিপরীতে ১০ কেজি চাল পাওয়ার কথা থাকলেও তাদেরকে দেয়া হয়েছে ৮-৯ কেজি করে। অভিযোগ রয়েছে,তালিকায় নাম থাকলেও চাল পায়নি অনেকেই। অথচ তালিকায় নাম না থাকলেও চেয়ারম্যান,ইউপি সদস্য ও প্রভাবশালীদের দেয়া টোকেনে চাল পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন সুবিধাভোগীরা।
রহিমা বেগম (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে বিধবা ভাতার সুবিধা পেলেও ভিজিএফ’র তালিকায় তার নাম নেই। এমনকি এবছর নতুন করে তালিকা হয়নি। ফলে তার নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোন সুযোগও নেই। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চাল পেয়েছেন এক ব্যবসায়ীর দেয়া টোকেন দেখিয়ে। সেই টোকেনে গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সাক্ষর থাকলেও কার্ডধারীর নাম ঠিকানা বা ওয়ার্ড সম্পর্কিত কোন তথ্য দেয়া নেয়।
তিনি জানান, হঠাৎ করেই জেলা শহরের এক ব্যবসায়ী আমাকে কার্ড দিয়ে বলে,এটি দেখিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে চাল তুলতে পারবে। মঙ্গলবার এই টোকেন দেখিয়ে চাল তুলে এনেছি। গোবরাতলা ইউনিয়নের বাসিন্দা বা জনপ্রতিনিধি না হয়েই ওই ব্যবসায়ী তাকে কিভাবে ভিজিএফ’র চাল দিয়েছে,জানতে তিনি এবিষয়ে জানেন না বলে জানান।
গোবরাতলা ইউনিয়নের দিয়াড় ধাইনগর গ্রামের স্কুলছাত্র আশিক আলী তার বাবার নামে বরাদ্দ হওয়া চাল নিতে এসেছিলেন মঙ্গলবার সকালে। ইউনিয়ন পরিষদে চাল নেয়ার পর তার চাল পরিষদের সামনে থাকা তরমুজের দোকানের ডিজিটাল স্কেলে মাপা হয়। সেখানে দেখা যায়,১০ কেজি চালের জায়গায় দেয়া হয়েছে ৮ কেজি ২৭০ গ্রাম।
আশিকের থেকেও ওজনে কম চাল পেয়েছেন প্রথমবারেরমতো ভিজিএফ’র চাল পাওয়া মুনসুর আলী (৬২)। তিনি জানান,এর আগে কোনদিন ইদের আগে এমন সরকারি চাল পায়নি। এবারই প্রথম চেয়ারম্যানের লোক আগেরদিন রাতে বাড়িতে এসে একটা টোকেন ধরিয়ে চাল নেয়ার কথা বলে গেছে। ১০ কেজি বলে চাল দিলেও ইউনিয়ন পরিষদের বাইরে মেপে দেখলাম ৮ কেজির একটু বেশি। আমরা শুনেছি, সরকার দিয়েছে ১০ কেজি করে। কিন্তু তারা আমাদের যা দিয়েছে, এতেই আমাদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে,কারন এছাড়া উপায় নাই।
গোবরাতলা ইউনিয়নের ভিজিএফ’র তালিকায় নাম রয়েছে চাঁপাই-মহেশপুর গ্রামের দিনমজুর জহুরুল ইসলামের। কিন্তু এবছর চাল পায়নি তিনি। এবিষয়ে তিনি বলেন, গত ৩-৪ বছর থেকে ইদের আগে ভিজিএফ’র চাল পায়। কিন্তু এবার আমাকে টোকেন দেয়নি। অথচ আমাদের বাড়ির আশেপাশের অনেকেই এবার নতুন করে চাল পেয়েছে। বিষয়টি জানতে চাইলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিছুই জানেন না বলে জানান।
জহুরুলের মতোই ভিজিএফ’র তালিকায় নাম থাকলেও চাল পায়নি স্বামী পরিত্যক্তা সুরমা বেগম। তিনি জানান,প্রত্যেক ইদের আগে ১০ কেজি করে কয়েক বছর ধরে চাল পায়। কিন্তু এবছর দেয়নি। কোনদিন না পেলেও আমার বাড়ির আশেপাশের অনেক প্রতিবেশী শুধুমাত্র টোকেন পেয়ে চাল নিয়েছে। অথচ জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছিলাম আমরা।
আগের বছরের তালিকায় চূড়ান্ত রয়েছে জানিয়ে গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.রবিউল ইসলাম টিপু বলেন,এবছর নতুন করে এই ইউনিয়নে ভিজিএফ’র তালিকা হয়নি। যে বরাদ্দ পাওয়া গেছে, তা ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্যদেরকে বিতরণের জন্য বন্টন করে দেয়া হয়েছে৷ তারা তালিকার বাইরে নিজেদের লোকদের মাঝে বন্টন করলে স্বাভাবিকভাবেই তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তিরা চাল পাবে। এছাড়াও স্থানীয় সাংসদসহ কিছু জনপ্রতিনিধিদের মাঝে কিছু কার্ড দেয়া হয়েছে, যা তারা নিজেদের লোকদের মাঝে বন্টন করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে কার্ডধারী কিছু সুবিধাভোগী বাদ পড়তে পারে।
তিনি আরও জানান,ওজনে কম দেয়ার প্রশ্নই আসে না। প্রথম দিনে ১৪০০ সুবিধাভোগীর মাঝে ভিজিএফ’র চাল বিতরণ করা হয়েছে। সেখানে প্রত্যেকে নূন্যতম ৯ কেজি ৫০০ গ্রাম করে পেয়েছেন। কারন পাটের বস্তায় কয়েক দফা চালের বস্তা উঠানামা করতে গিয়ে চাল পড়ে পরিমাণ কমে যায়। এছাড়াও চাল বিতরনের সময় ইউনিয়ন পরিষদে ভিক্ষুক ও অনেক হতদরিদ্র মানুষজন এসে বারবার অনুরোধ করলে,তাদেরকেও না করতে পারছি না। তখন বাধ্য হয়েই মানবিকতার খাতিরে তাদের মাঝেও চাল দিতে হচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ইউনিয়নে একজন করে ট্যাগ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যারা সার্বিকভাবে এসব কার্যক্রম দেখভালো করেন। গোবরাতলা ইউনিয়নে ট্যাগ কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আহমেদ আবু আল আমিন জানান, সঠিকভাবে সকল নিয়ম মেনে ভিজিএফ’র চাল বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। কোন অনিয়ম করা হয়নি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রওশন আলী বলেন, ওজনে কম দেয়ার কোন সুযোগ নেই। ১০ কেজির জায়গায় ৮-৯ কেজি চাল প্রদান এবং তালিকা ছাড়াই অন্যদের মাঝে বিতরণ ও তালিকায় নাম থেকেও না পেলে এর বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য,আসন্ন ইদুল ফিতর উপলক্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে মোট ৫৪ হাজার ৯৯৩টি কার্ডে ৫৪৯ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।