স্টাফ রিপোর্টারঃ
‘ঈদের আগে ছেলে বলতো মা আমাকে নতুন জামা দিতে হবে। সঙ্গে লাগবে প্যান্ট-জুতা। এরকম নানা ধরনের বায়না থাকতো আমার ছেলেটার। ঈদ বকশিস না দিলে কেঁদে কেটে একাকার করতো। আজ কোথায় তার বায়না, কোথায় অভিমান। ছেলেটার মুখ দেখিনা কতো বছর হয়ে গেলো। ঘরে বৌ আসার পর আমার খোঁজ নেয় না সে। মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তার কাছে।’
অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলেন বগুড়ার বাঘোপাড়া প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দা মনোয়ারা (৬৮)। তিনি সাত বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানে আছেন। জানালেন আগে ঈদের দিনগুলোতে বেশি খারাপ লাগতো। এখন আর খারাপ লাগে না। ধরেই নিয়েছেন তার কেউ নেই। প্রবীণ নিবাসে যারা আছেন, তারাই তার প্রিয়জন।
মনোয়ারা বলেন, প্রতিবছর ঈদের সময় পথ চেয়ে থাকি ছেলেটা হয়তো আসবে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি বসে থাকি একসঙ্গে সেমাই-মিষ্টি খাবো বলে। কিন্তু দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আমার একাকী বসে থাকার সময় ফুরোয় না।
৬০ বছর বয়সী ফৌজি আলম নামের এক বৃদ্ধা এ নিবাসে আছেন ১০ বছর ধরে। জানালেন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনজনরা তাকে পর করে দিয়েছে। কারণ তিনি সবার বোঝা ছিলেন। নানা সময় অসময়ে কথা শুনতে হতো তাকে। এখন অনেক ভালো আছেন। তিন ছেলে মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ ফোন দিয়ে খোঁজ নেন।
ঈদের সময়ের স্মৃতিগুলো মনে করে ৭০ বছর বয়সী পরিচয় প্রকাশ না করা এক নারী বারবার তার মুখে কাপড় দিয়ে চোখ মোছার চেষ্টা করছিলেন। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে হয়তো বা এখন অনেক কিছু মনে পড়ে না তার। অথবা কিছু মনে করতেও চান না তিনি।
শুধুমাত্র এ তিনজনই নন, বগুড়ার প্রবীণ নিবাসগুলোতে থাকা দুশতাধিক বাবা-মায়ের মনে অন্যদের মতো ঈদের আনন্দ নেই। নেই কোনো আপনজনের অপেক্ষা। কারণ তারা জানেন কোনো আপনজনই তাদের আর খোঁজ নেবে না।
এক সময় স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, বাবা- মা এবং পরিবার সবই ছিল তাদের। কিন্তু ভাগ্যের কষাঘাতে তারা এখন বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা। কোনো আপনজন থেকেও নেই তাদের।
আপনজনহীন মা-বাবাদের আপন করে নিয়েছে টিএমএসএস মাসুদা প্রবীণ নিবাস। রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ মায়েদের তুলে এনেছেন তারা। করছেন সেবা যত্ন, ব্যবস্থা করেছেন চিকিৎসার এবং থাকা খাওয়ার। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পরে এ মা-বাবার দাফন কাফন সবই করে এ বৃদ্ধাশ্রম।
প্রবীণ নিবাসের সুপার মনোয়ারা খাতুন বলেন, সন্তানের সুখ বঞ্চিত মায়ের অভাব কারও পক্ষেই পূরণ সম্ভব নয়। এরপরও দুঃখ ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় এখানে। নেওয়া হয় নিবাসীদের যত্ন, সেবার ব্যবস্থা। নিবাসীদের সবার জন্য আমৃত্যু খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান ও বিনোদনের সংস্থান করা হচ্ছে কেন্দ্রটিতে।
এদিকে দেশে প্রবীণদের জন্য পর্যাপ্ত নিবাসের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে বল মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের জনমিতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দশক থেকেই বাংলাদেশে বয়স্ক বা প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকবে এবং ২৫ বছর পরই বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি বয়স্ক সোসাইটিতে।
অথচ বার্ধক্য নিয়ে মানুষের নিজেদের মধ্যেও যেমন কোনো চিন্তা করতে দেখা যায় না, তেমনি প্রবীণদের জন্য সম্মানের সঙ্গে আনন্দমুখর বার্ধক্য নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও নেই। কিছু প্রবীণ নিবাস থাকলেও সেগুলোতে যারা থাকেন তাদের নিয়ে নেতিবাচক প্রচারই বেশি হয়। যেমন বলা হয় ছেলে মেয়েরা বাসায় থাকতে দেয় না কিংবা খোঁজ খবর নেয় না বলেই তারা এখানে।
অথচ পরিবার কাঠামো এবং বাস্তবতা বিবেচনা করলে বয়স্কদের জন্য অনেক সময় চাইলেও সন্তানরা পর্যাপ্ত সময় দিয়ে সেবা করতে পারে না। তাই নেতিবাচকভাবে না দেখে বরং ইতিবাচক দৃষ্টি থেকেই প্রবীণ নিবাসের মতো প্রাতিষ্ঠানিক কেয়ারের চিন্তা করা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ এস এম আতীকুর রহমান।
তিনি ১৯৮১ সাল থেকে প্রবীণদের নিয়ে কাজ করছেন। তার মতে প্রতি উপজেলায় প্রবীণ নিবাস হওয়া উচিত। একজন মানুষ অবসরজীবন কীভাবে কাটাবে, তার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত হবে এগুলো নিয়ে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৮৫টি শিশু পরিবার আছে। এর মধ্যে ছেলে শিশুদের জন্য ৪৩টি পরিবারে ১০ জন করে পুরুষ ও মেয়ে শিশুদের জন্য যে ৪১টি পরিবার সেখানেও ১০ জন করে নারী প্রবীণ থাকতে পারবেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, এ জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় এবং বিভিন্নভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয় যাতে প্রবীণরা শিশু পরিবারগুলোতে আসেন। এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত ছয়টি প্রবীণ নিবাস আছে। এ প্রবীণ নিবাসগুলোতে ৫০ জন করে থাকার সুযোগ আছে। এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে দেশে বেশ কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম আছে বগুড়া, সাভার, গাজীপুরসহ কয়েকটি এলাকায়। এরমধ্যে বগুড়ায় শিশু পরিবারসহ মোট পাঁচটি কেন্দ্র আছে।
অধ্যাপক এ এস এম আতীকুর রহমান বলছেন, প্রবীণ তিন ধরনের। ৬০-৭০ বয়সীরা তরুণ প্রবীণ, ৭০-৮০ বছর বয়সীরা মধ্য প্রবীণ এবং ৮০ থেকে তদূর্ধ্বরা অতি প্রবীণ। ২০৬১ সাল নাগাদ প্রবীণের মোট সংখ্যা ৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু এখনো এ বিষয়ে কোনো দৃষ্টিই নেই কারও।
বাংলাদেশের সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, বয়স্ক ভাতা পান প্রায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ। প্রতিমাসে একজন ব্যক্তিকে ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়া হয়।
বৃদ্ধ অবস্থায় পিতা-মাতাকে সন্তানের কাছ থেকে সুরক্ষা দেবার জন্য ২০১৩ সালে ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন’ প্রণয়ন করে সরকার, যেখানে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী কোনো সন্তান তার পিতা-মাতাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস বা অন্য কোথাও আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না।
পিতা-মাতার জন্য ভরণ-পোষণ এবং চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর বাধ্যবাধকতা আছে এই আইনে এবং সন্তানরা যদি এসব দায়িত্ব পালন না করে তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
পিতা-মাতা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে ১ লাখ টাকা জরিমানা অথবা তিনমাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
বয়স্ক ব্যক্তির কথা ভেবে ২০১৬ সালে সরকার দেশে প্রথমবারের মতো সবগুলো শিশু পরিবারে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্কদের আবাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। প্রতিটি শিশু পরিবারে বিশেষায়িত দশটি করে আবাসন সংরক্ষিত আছে। যে শিশু পরিবার শুধু মেয়েদের জন্য সেখানে শুধু বৃদ্ধারা থাকতে পারেন। বগুড়ার শিশু পরিবারটি বর্তমানে শুধু মেয়েদের জন্য। ১৯৫৯ সালে কয়েকটি ঘর নিয়ে নগরীর উত্তরে ফুলবাড়ি এলাকায় মহাসড়কের ধারে শিশু পরিবার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে বগুড়া শিশু পরিবার শুধু এতিম মেয়েদের নিবাসী করা হয়।
বগুড়া সমাজকল্যাণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বলেন, বগুড়া শিশু পরিবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহের মধ্যে। এখানে বয়স্করা জীবনের প্রান্ত বয়সে শিশুদের সঙ্গে থেকে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন। তাদের থাকা খাওয়া চিকিৎসা কাপড় ও আনুষঙ্গিক সব কিছুই সরকার বহন করবে। সুপরিসর জায়গা, গাছগাছালি, পুকুরঘাট সবই আছে। টেলিভিশন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে। নিজের বাড়ির মতো পরিবেশ সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে। দেশের প্রতিটি শিশু পরিবারেই এমন ব্যবস্থা আছে।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় রক্তের সম্পর্ক স্নেহের সম্পর্কের কাছে হার মানে। শিশু পরিবারে থাকার সময় তারা এতিম শিশুদের কাছ থেকে ভালোবাসা পাবেন।