পবার বড়গাছী হাট এখন জায়গা বেচাকেনার হাট

রাজশাহী

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ

সরকারি নিয়ম না মেনে, হাটে স্থায়ী পাকা দোকানঘর নির্মাণ, বরাদ্দের নামে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করে স্বজন প্রীতির মাধ্যমে হাটের জায়গা নিয়ে বানিজ্য চলছে রাজশাহী পবা উপজেলার বড়গাছী ইউনিয়নের হাটে। বঞ্চিত ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন এসব অনিয়মে ইএনও ও এসিল্যান্ড সহ সরকারি কর্মকর্তারাও জড়িত। 

৭ আগস্ট (সোমবার) বড়গাছী হাটে সরেজমিনে গেলে এর সত্যতা মিলে, সংবাদকর্মীদের এরকমই তথ্য দিয়েছেন হাটের প্রকৃত ব্যবসায়ী ও আশপাশের সাধারণ মানুষ।

 সরকারি নিয়ম বর্হিভূতভাবে হাট বানিজ্যে লিপ্ত হয়েছেন বর্তমান বাজার কমিটির সভাপতি এমদাদ ও সেক্রেটারি আফজাল। এমদাদ পবা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও তার ছেলে ৮ নং বড়গাছী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সাগরের প্রভাবে সরকারী খাস জায়গায় নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে, হাটের বরাদ্দকৃত জায়গা বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। 

 স্থানীয় প্রভাবশালী ঐ মহলটি বড়গাছী হাটে সরকারি খাস জায়গায় ৩২ টির মতো পাকা দোকানঘর নির্মাণ করছেন। ঐ হাটে দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবসা করা ব্যবসায়ীদের সুযোগ না দিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের নামে হাটে বেসরকারিভাবে তৈরি প্রতিটি দোকানঘর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা থেকে ৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে।

প্রায় কোটি টাকার হাট বানিজ্যে ইউএনও ও এসিল্যান্ড এর নামে নেওয়া হচ্ছে মোটা অংকের কমিশন। প্রকাশ্যে এসিল্যান্ডের বরাদ্দে দোকানঘর বিক্রি ও কে কত ভাগ কমিশন পাচ্ছেন তা জানিয়েছেন স্থানীয় ভুক্তভোগী দোকানদারগণ। আবার পুরনো স্থাপনা গুলো ভেঙে কোন রকম টেন্ডার ছাড়াই রড, ইট, সাটার, এঙ্গেল সহ অন্যান্য পুরনো জিনিসপত্র বিক্রিতেও সরকারি প্রায় ২০-২৫ লক্ষ টাকার ক্ষতি সাধন হয়েছে। 

এদিকে ভুক্তভোগী দোকানদাররা এবিষয়ে আদালতে মামলাও করেছেন। মামলা করায় এমদাদের ইন্ধনে সাজ্জাদ নামে একজন পাকা দোকানঘর বরাদ্দ নেওয়া আরেক ব্যক্তি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পবা থানায় চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগও করেছেন বলেন জানান এ হাটের ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা। 

জানা যায়, বড়গাছী হাটে পুরাতন টিনসেড বাজার ভেঙে ফেলে নতুন ভাবে ব্যক্তি উদ্দ্যোগে বাজার সংস্কারের কাজ শুরু করা হয়। এর আগে পবার এসিল্যান্ড খবর পেয়ে পাকা দোকানঘর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। পরে তিনি মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে পাকা দোকানঘর নির্মাণ করার অলিখিত অনুমোদন দেন। অলিখিত অনুমোদন পাওয়ার পর বানিজ্যের হোতারা এসিল্যান্ডের সামনেই ঐ ইউনিয়নের ২ নং ইউপি মেম্বার সফিকুলকে মারধরও করেন।

 কেনোনা তিনি হাটে অবৈধভাবে ব্যক্তি উদ্যোগে পাকা দোকানঘর নির্মাণ ও তা ৯৯ বছরের জন্য ব্যবসায়ীদের ভুল বুঝিয়ে লীজ বরাদ্দের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি সরকার কর্তৃক পূর্বের নির্মাণ করা দোকানঘর বরাদ্দ নেওয়া (মালিক) বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে তাঁর দোকান ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছেন এসিল্যান্ড। 

ইতোমধ্যে পূর্বের সরকার কর্তৃক নির্মাণ করা কয়েকটি দোকানঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে। 

অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে উক্ত বিষয়ে এমদাদ, শাহাদাত হোসেন সাগরসহ আরো ৪ জনের বিরুদ্ধে সফিকুল ইসলামের বড় ভাই শহিদুল আলম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। পরে আদালত থেকে মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেয় আদালত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বড়গাছি হাটের জায়গায় থাকা সরকারিভাবে নির্মিত ৬ পাকা টিনসেড ২টি সম্পূর্ণ ও ৪টি অর্ধেকসহ দোকানপাট নোটিশ দিয়ে ভাঙিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। হাটের সরকারি এসব স্থাপনা ভেঙ্গে টিন, লোহার এ্যাঙ্গেল, রড, ইট কোন টেন্ডার ছাড়াই প্রশাসনের নিরব সহযোগিতায় বিক্রি করেছে হাট সভাপতি এমদাদ।

যার আনুমানিক মুল্য ২০-২৫ লাখ টাকা। ভাঙ্গা জায়গায় সরকারি কোন প্রকল্প না থাকলেও নিজেদের পকেট ভরাতে ৩২ টি দোকান ঘর নির্মান কাজ চলছে। এই দোকানগুলি যার টাকা আছে, তিনিই পাচ্ছেন। টাকা না থাকলে ব্যবসায়ীরাও দোকান পাচ্ছেন না। দোকানের পজিশন বরাদ্দ নিতে নেওয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন ৭০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। ওই বাজারে বাকি পাকা টিনসেডগুলিও ভেঙ্গে ঘর নির্মান করা হবে। সেগুলিও বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

বড়গাছি বাজারে ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে ভাতের হোটেল ব্যবসা করেন শামিম (২৮)। তিনি বলেন, আমি দোকান ঘর নিতে হাট কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নগদ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছি। আমার মত যারা ঘর নিচ্ছেন তাদের প্রত্যেককে টাকা দিয়েই ঘর নিতে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে দোকান না থাকলেও বড়গাছি বাজারে অনেকে জায়গা বরাদ্দ পেয়েছেন। তাঁদের দোকান ঘর বরাদ্দ নিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দেড় থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। আগে থেকে কারও দোকান থাকলে তাকেও টাকা দিয়ে ঘর নিতে হচ্ছে যার পরিমান সর্বনিম্ন ৭০ সত্তর হাজার টাকা। পূর্বের অনেক দোকানদার টাকা দিতে চাইলেও মিলছেনা কাঙ্খিত পজিশন। কারণ হিসেবে জানা গেছে সামনের সারির দোকানগুলো আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে আগেই বেচে দেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি জানতে চাইলে, হাট কমিটির সভাপতির ছেলে ইউপি চেয়ারম্যান সাগর বলেন, সরকারি ফরমে আবেদনের মাধ্যমে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা দোকানঘর সরকারি ফি দিয়ে বরাদ্দ নিবেন। বেশি টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। একটি পক্ষ মিথ্যাচার করছেন। কেউ প্রমাণ করতে পারলে চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিবো। তবে হাটে পাকা দোকানঘর নির্মাণ করছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। এখানে ইউনিয়ন পরিষদের কিছু নাই। নির্মাণ কাজটি উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে বলেও জানান ইউপি চেয়ারম্যান। পুরাতন টিনসেড গুলো একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিক্রয় করা হবে। 

বাজার কমিটির সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, আমি হাটটি ইজারা নিয়েছি। হাটের উন্নয়নে সকল দোকানদারের সম্মতিতে পাকা দোকানঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। পাকা দোকানঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে। এতে যা খরচ হচ্ছে তা বরাদ্দ পাওয়া দোকানদারদের নিকট থেকে নেওয়া হবে। 

টাকা লেনদেনে সংশলিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে পবার সহকারী কমিশনার ভূমি (এসি ল্যান্ড) অভিজিৎ সরকার বলেন, হাটটি নতুন করে সংস্কার করা হচ্ছে। কাজটি হাট সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদ করছেন। টাকা লেনদেনের বিষয়টি সঠিক নয়। তবে কেউ যদি কেউ টাকা নেন বা ভুক্তভোগীরা যদি লিখিতভাবে অভিযোগ দেয় তবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি আইন অমান্য করে অনিয়ম করা হয়, তবে সে যেই হোক তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। এসময় তিনি দোকানদারদের থেকে এলআর ফান্ডে কিছু টাকা জমা হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন।

পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও ) লসমী চাকমাকে একাধিকবার ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করে হাটের বিষয় শুনে ফোন কেটে দেন। এরপর তাঁর অফিসে দেখা করতে গেলে তিনি অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেও দেখা করেননি। তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *