রাজশাহীতে সরকারি তিন কলেজের অধ্যক্ষ আওয়ামী লীগ নেতা!

রাজশাহীতে সরকারি তিন কলেজের অধ্যক্ষ আওয়ামী লীগ নেতা!

রাজশাহী

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

সরকারি চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক পদ-পদবীর অপব্যবহারসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে রাজশাহীর সরকারি তিনটি কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হয়েও তাঁরা কিভাবে দলীয় পদে থাকতে পারেন-তা নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

এর মধ্যে জেলার দুর্গাপুর উপজেলার দাওকান্দি সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিসহ তাঁর দলীয় পদে থাকা নিয়ে লিগ্যাল নোটিশও করেছেন ওই কলেজের এক ছাত্রী। তবে এখনো দুটি পদ ধরে রেখে বহাল তবিয়তে আছেন অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক।

এছাড়াও রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজ উদ্দিন কবিরাজ মোহনপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও বানেশ্বর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ একরামুল হক রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাঁরাও দুটি পদেই বহাল রয়েছেন এখনো। তাঁদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ।

দলীয় সূত্র মতে, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ দুর্গাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতি আব্দুল মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক পদে দাউকান্দি সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হককে মনোনীত করা হয়। এর পর থেকে মোজাম্মেল হক এখনো ওই পদটি ধরে রেখেছেন। অথছ এই কলেজটি ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট সরকারি কলেজ হিসেবে গ্যাজেটভূক্ত হয়। গত মার্চ মাস থেকে শিক্ষক-কর্মচারীরাও সরকারি কলেজের স্কেলে বেতন পাচ্ছেন। তার পরেও অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পটদি ধরে রেখেছেন।

এরই মধ্যে অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হকের পদটি কেন অবৈধ নয়, তা জানতে চেয়ে ওই কলেজের মিতালী খাতুন নামের এক ছাত্রী গত ২০ জুলাই আইনী নোটিশ পাঠিছেন। নোটিশ প্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত থেকে কলেজের আয়-ব্যয়ের হিসাব কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অবহিত করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যথায় দেশের প্রচলিত দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতে প্রতিকার চেয়ে মামলা করা হবে বলেও আইনী নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

ওই নোটিশে কলা হয়, দাওকান্দি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হওয়া সত্বেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত রয়েছেন মোজাম্মেল হক। এমনকি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত হয়েছেন অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক। যা গণকর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ এর ২৫ ধারার পরিপন্থী।

আইনী নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক দিনের পর দিন কলেজে অনুপস্থিত থাকলেও হঠাৎ একদিন কলেজে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে শতভাগ উপস্থিতি দেখান।

দাওকান্দি হাটের ইজারাদারের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করায় অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হকসহ আরও কয়েকজন শিক্ষকের নামে আদালতে মামলা দায়ের করেন ইজারাদার বোরহান আলী। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। ওই মামলাপির কপিও আইনে নোটিশে দেওয়া হয়।

উচ্চ আদালতের আইনজীবী এ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামানের মাধ্যমে ওই নোটিশটি পাঠান শিক্ষার্থী মিতালী খাতুন। তিনি দাওকান্দি কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় লেখাপড়ার খরচ বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে মিতালীর। নিয়ম অনুযায়ী উপবৃত্তি পাওয়া কথা থাকলেও মিতালী খাতুনকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হকের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, সরকারি গণকর্মচারী বিধিমালা লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক দলের অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে চাঁদাবাজি, কলেজের সম্পদ তছরুপ, আয়-ব্যয়ের হিসাব না দেওয়া সহ অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হকের নানা অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধে মিতালী খাতুনের পক্ষে আইনী নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

মিতালী খাতুন দাবি করেন, তিনি এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী উপবৃত্তি পাওয়ার কথা থাকলেও অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হকের অনুসারী না হওয়ায় উপবৃত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার অধ্যক্ষকে জানানো হলেও অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক কর্ণপাত করেননি।

মিতালী খাতুন অভিযোগ করে বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক। আর এই কাজে নেপথ্যে থেকে সহযোগিতা করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ আব্দুল ওয়াদুদ দারা। ওই নেতার আশীর্বাদপুষ্ঠ অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে আসছেন। যা দেখার কেউ নাই।

জানতে চাইলে দাওকান্দি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ব্যাক্তিগত ভাবে ও রাজনৈতিক ভাবে আমার সুনাম ক্ষুন্ন করতে মিথ্যা অভিযোগ এনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমি আগেও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলাম। এবার দল আমাকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত করেছেন। সংগঠনের স্বার্থে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ চাইলে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি নেবো।’

আইনী নোটিশ পাওয়ার কথা অস্বীকার করে অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক দাবি করেন, আইনী নোটিশটি ভুয়া। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নাই। কলেজে সবকিছু আছে।

এদিকে, মোহনপুর উপজেলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মফিজ উদ্দিন কবিরাজ ২০২২ সালের মে মাসে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। এর আগেও তিনি ওই পদে ছিলেন। অথচ ওই কলেজটিও ২০১৮ সালের ৮ মে সরকারি হিসেবে গ্যাজেটভূক্ত হয়। কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা গত মার্চ মাস থেকে বেতন পাচ্ছেন সরকারি কলেজের স্কেলে।

ওই কলেজের একাধিক শিক্ষক-কর্মচারী বলেন, ‘কলেজের নিয়োগসহ নানা কাজে ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। এসব নিয়ে কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারে না। দলীয় এবং অধ্যক্ষ পদে থাকার কারণে তাঁর ক্ষমতার দাপটে কেউ মুখ খুলতে পারেন না।’

জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মফিজ উদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমি দলীয় পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। তবে দল থেকে সেটি গ্রহণ করা হয়েছে কিনা জানি না। তবে আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয়।’

অপরদিকে, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে। ওই সম্মেলনের পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহসভাপতি পদ নাম রাখা হয় বানেশ্বর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ একরামুল হককে। অথচ এক বছর আগেই কলেজটি সরকারিকরণ হয়। বানেশ্বর ডিগ্রি কলেজ মাঠে হাট বসানো এবং নিয়োগসহ নানা খাতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আছে একরামুল হকের বিরুদ্ধে। তবে এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য একরামুল হককে বার বার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভি করেননি।

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার বলেন, গণকর্মচারী বিধি লংঘন করে অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হকসহ তিনজন জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের পদে আসীন আছেন এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সারাদেশেই এ বিষয়টি নিয়ে সাংগঠনিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিপ্তরের পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সরকারি চাকরি করে কেউ দলীয় কর্মকাণ্ডে এমন কি ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত থাকতে পারবেন না এটি যদি করে থাকেন তাহলে, তিনি অন্যায় করছেন। গোপনে বা প্রকাশ্যে দলীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা সরকারি চাকরিবিধির লঙ্ঘন।’

সূত্র-কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *