মোঃ মনোয়ার হোসেন, রাজশাহী
আদালতে নির্দেশনা অমান্য করে জালিয়াতি মাধ্যমে জমি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ যুবলীগ নেতা তৌরিদ আল মাসুদ রনির বিরুদ্ধে। ওই জমির মালিক আবু হানিফ প্রথমে জমিটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমানকে দেন। পরে সেই জমি জালিয়াতি মাধ্যমে রনিকে প্রদান করেন।
মোস্তাফিজুরের টাকা ও জমি ফেরত না দিয়ে তা হাতিয়ে নিতে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন তারা। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তুরুপের তাস হিসেবে এজাজুল হক নামে এক ব্যক্তিকে ব্যবহার করে মিথ্যা প্রতারণা মামলা দায়ের করেন মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে।
তাঁর বিরুদ্ধে চালানো হয় নানা প্রোপাগাণ্ডা। রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও এসকে এন্ড ট্রায়াঙ্গল রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌরিদ আল মাসুদ রনি এবং তার সহযোগি মাহাতাব উদ্দিন চন্দন, সান রমিও, খায়রুল আনামের সহযোগিতায় ওই জমি জালিয়াতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
জমি জালিয়াতির অভিযোগের সুত্রপাতে নানা হয়রানি ও হুমকি ধামকিসহ বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে মধ্যে আছেন ভূক্তভোগী গ্রীন প্লাজা রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর নেওয়া জমিটি দখল নিতে ও অর্থ আত্মসাৎ করতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত মো. আবু হানিফ ও রাজশাহী জেলা সাব-রেজিস্টার কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনকারীদের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা।
মোস্তাফিজুরের সঙ্গে জমি জালিয়াতি চক্রের দ্বন্দ্ব থেকে অর্থ দিয়ে প্রতারণা মামলা দায়ের পুর্বক তাকে ফাঁসানো হয়। যদিও সেই মামলায় তাকে গ্রেফতার করলেও আদালত তাকে ওইদিনই জামিন দেন।
চক্রটি ফ্ল্যাট ক্রয়কারী এজাজুল হক নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে ডকুমেন্টস ছাড়াই মিথ্যা মামলা করান। যদিও ওই ব্যক্তির ফ্ল্যাট ক্রয় করতে ব্যর্থ হয়ে মোস্তাফিজুরের নিকট থেকে টাকা ফেরত নিয়েছেন।
এসব বিষয়ে গত সোমবার (১১ মার্চ) দুপুরে জেলা সাব-রেজিস্ট্রার ও রাজশাহী জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন ভূক্তভোগী গ্রীন প্লাজা রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
ওই অভিযোগ সুত্রে জানা যায়, মহানগরীর দড়িখরবোনা এলাকার বাসিন্দা আবু হানিফের বোয়ালিয়া মৌজার (জে এল নং ৯ মৌজা : বোয়ালিয়া, দাগ নং ৩২৪৫, ৩২৪৬, ৩২৪৭) রাজশাহীর অন্তর্গত ০.০৪৪২ শতাংশ জমি নগর যুবলীগ নেতা তৌরিদ আল মাসুদ রনি ও তার সহযোগিদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের সহযোগিতায় জালিয়াতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করেছেন। যার প্রস্তাবিত খতিয়ান নম্বর ৯৭২০, হোল্ডিং নম্বর ৯৮১৪ ও হালদাগ নম্বর যথাক্রমে ৩২৪৫,৩২৪৬ এবং ৩২৪৭। এই কাজে জেলা সাব-রেজিস্টার কার্যালয়ের কিছু দুর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তারাও জড়িত আছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ‘আমার (মোস্তাফিজুর) সাথে আবু হানিফ ২৮/১১/২০২২ এবং ০৫/০১/২০২৩ ইং তারিখে একটি চুক্তিপত্র ও একটি আমমোক্তার নামা নন-জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্প সম্পাদন করেন এবং আমার নিকট হইতে মোট দুই কোটি ৩২ লক্ষ টাকা স্বাক্ষীগণের উপস্থিতিতে গ্রহণ করেছেন এবং উক্ত তফশীল বর্ণিত সম্পত্তি আমাকে দখলসহ জমির সকল দলিল, বায়া দলিল,খাজনা রশীদ, ডিসিআর রশীদ, প্রস্তাবিত খতিয়ান সহ সকলপ্রকার মূল কাগজপত্র বুঝিয়ে দেন।
পরবর্তীতে এসকে এন্ড ট্রায়াঙ্গল রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌরিদ আল মাসুদ রনি নিযুক্তীয় মাহাতাব উদ্দিন চন্দন উক্ত জায়গা পাওয়ার লোভে পেশীশক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে গ্রীন প্লাজা রিয়েল এস্টেট এর সাইন বোর্ড ভাংচুর করে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করেন। পাওনা দুই কোটি ৩২ লক্ষ টাকা দিতে হবেনা, মামলা-মোকদ্দমা হলে সব দেখবে বলে ভূমি মালিক আবু হানিফ কে প্রলোভিত করেন রনি।
আবু হানিফ প্রলোভিত হয়ে তাদের যোগসাজশে পরিকল্পনায় লিপ্ত হয়ে প্রথমে মোস্তাফিজুরের জমিটা দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। মোস্তাফিজুরকে ‘জায়গা ও টাকা না দিয়ে দলিল উঠাতে সকল পরিকল্পনা করেন এবং মোস্তাফিজকে হুমকি দেওয়া হয় জায়গা ছেড়ে দেওয়াসহ দলিল ফেরত দেওয়ার জন্য। জোর পুর্বক জমিটি’র দখলে নিয়ে মোস্তাফিজুরের সাইন বোর্ড তুলে ফেলা হয়।
বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা (মোকদ্দমা নং- পি-১২৬৬/২০২৩) দায়ের করিলে বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক উক্ত তফশীল বর্ণিত সম্পত্তির ওপর ১৪৫ ধারায় নিষেধাজ্ঞা আদেশ জারি হয় যা অদ্যবধি চলমান রহিয়াছে। পরবর্তীতে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মামলা (মোকদ্দমা নং- ২১৮/২০২৩) দায়ের করিলে ধার্য্য তারিখ আগামী (২১/০৫/২০২৪ ইং যাহা অদ্যবধি চলমান) প্রদান করেন আদালত।
উক্ত মোকদ্দমায় তফশীল বর্ণিত সম্পত্তির সকল দলিল, বায়া দলিল, খাজনা রশীদ, ডিসিআর রশীদ, প্রস্তাবিত খতিয়ান সহ সকল প্রকার মূল কাগজপত্র দলিলাদি ফিরিস্তিযোগে বিজ্ঞ আদালতে জমা রাখা হয়। জমির মালিক মোস্তাফিজুর রহমানের প্রদানকৃত অর্থ ফেরৎ দিতে অস্বীকার করিলে বিজ্ঞ আমলী আদালতে (বোয়ালিয়া সি আর নং ১৩৫৫/২০২৩) মামলা দায়ের করা হয়।
মামলাটি তদন্ত সাপেক্ষে বিজ্ঞ আদালত আসামী হানিফকে গত ২৮/১২/২০২৩ ইং তারিখে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। গত ০৭/০৩/২০২৪ ইং তারিখে রোজ বৃহস্পতিবার আসামী আবু হানিফ বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন (ধার্য্য তারিখ ১৩/০৩/২০২৪ ইং পর্যন্ত) জামিন প্রাপ্ত হয়।’
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, অসদুপায়ী গ্রহীতা এসকে এন্ড ট্রায়াঙ্গল রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌরিদ আল মাসুদ রনি এবং অসদুপায়ী দাতা ভূমিমালিক আবু হানিফ কর্তৃক বিজ্ঞ আদালতের আদেশ অমান্য করিয়া যোগসাজশে ০৭/০৩/২০২৪ ইং তারিখে রোজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আনুমানিক ০৮:০০ ঘটিকায় জেলখানা হতে জামিনে বের হয়ে ০৯/০৩/২০২৪ ইং তারিখ শনিবার ডিসিআর সহ সমস্ত প্রকার মূল দলিলপত্র বিজ্ঞ আদালতে সংরক্ষিত থাকাবস্থায় কমিশনে রেজিষ্ট্রি সম্পন্ন করিয়া বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় তা প্রচার করেন। ‘
বিজ্ঞ আদালতের নিষেধাজ্ঞার আদেশ ভঙ্গ করিয়া ০৯/০৩/২০২৪ ইং তারিখ শনিবার এ সম্পাদিত চুক্তিপত্র ও আমমোক্তার নামা দলিলের সকল প্রকার কার্যক্রম’ বন্ধ এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার মর্মে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে অভিযোগকারী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আবু হানিফ আমার সঙ্গে চুক্তি করে টাকা নিয়ে সে যুবলীগ নেতার সঙ্গে আতাত করে এবং সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করেন। আমার দলবল নেই। আমি আইনের আশ্রয় নিয়েছি। এতে প্রতারক আবু হানিফ কারাভোগ করে। কয়েকদিন আগে সে জামিনে বের হয়ে যুবলীগ নেতা রনি ও তার দলবল নিয়ে বিভিন্ন সময় আমাকে হত্যা হুমকিসহ রাজশাহী থেকে বের করে দেবার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
এর আগেও হানিফ ও তার ছেলে আমার প্রজেক্টে এসে যুবলীগের দলবল নিয়ে ভাংচুর করেছে। আমার লোকজনকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক দিন আগে দড়িখড়বোনা মোড়ে যুবলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী আমার গাড়ীর পথরোধ করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি দেন। এ কারণে আমি র্যাব, পুলিশ, আদালতে তাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা জনিত বিষয়ে অভিযোগ করেছি। আদালতের আইন অমান্য করে তারা জালিয়াতি করায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ করেছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানান জন্য আবু হানিফের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। একই অভিযোগে অভিযুক্ত নগর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘তার অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলে আমার মতো কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়ী কখনও ওই জায়গায় ইনভেস্ট করে! তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞাই নাই।
এসব তার (অভিযোগকারী মোস্তাফিজের) মনগড়া কথা।’ জেলা সাব-রেজিস্টার শফিকুর রহমান বলেন, ‘আদালতের আদেশ অমান্য করে এমন কাজ করলে তা ন্যায়সঙ্গত হবে না। আর এমন ঘটনা আমার জানা নেই। আমি বাইরে আছি। অভিযোগের বিষয়টি আপনার কাছে থেকে জানতে পারলাম।’ তিনি বলেন, ‘আমার দপ্তরে দু’জন সাব-রেজিস্টার আছেন- মোস্তাফিজুর রহমান ও নকিবুল ইসলাম। এদের কেউ এ কাজ টা করতে পারেন।
তাদের জিজ্ঞেস করুন। তারা ভালো বলতে পারবেন।’ জানতে চাইলে জেলা সাব-রেজিস্টার অফিসের সাব-রেজিস্টার নকিবুল ইসলাম বলেন, ‘রনি-মোস্তাফিজ নামের কোন ব্যক্তিকেই আমি চিনি না। তবে আবু হানিফ নামের একজন ব্যক্তি তার জমি কোন একজনকে পাওয়ার অব এটোর্নি করে দিয়েছেন।
ওই জমিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল কি-না তা আমার জানা নেই। তবে শুনেছি আজ (সোমবার) বিকেলে একটি আদেশ এসেছে। তবে এটা তাদের বিষয়ে কিনা তাও আমার জানা নেই।’
কথা বললে প্রতারণা মামলা করা এজাজুল হক বলেন, আমাকে সে কোনো টাকা ফেরত দেয়নি। টাকা পাই তাই মামলা করেছি।
এ ব্যাপারে রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহম্মেদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও না পাওয়ায় তার মন্তব্য মেলেনি।