রাজশাহী প্রতিনিধি :
সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির কমিটি নিয়ে বিরোধের জের ধরে দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলের মৃত্যু হয়। বাবুল নিহতের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজশাহীর রাজনীতি।
দলিল লেখক সমিতির বিরোধের জের ধরে ঘটে যাওয়া ঘটনায় পরস্পরকে দোষারোপ করে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক ইস্যূ তৈরীর চেষ্টা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। গত ২৭ জুন বাঘা মডেল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বাবুলের জানাজায় রাজশাহী-৬ আসনের এমপি সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহরিয়ার আলম দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ-সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ এবং বাঘা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলুকে এই হত্যাকাণ্ডে দোষারোপ করেছেন।
এরপর থেকে রাজশাহীর রাজনীতিতে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে। তবে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এমন বিস্ফোরক মন্তব্যের পর ওই দিনের সংঘর্ষের ঘটনার রহস্য সামনে আসতে শুরু করেছে। তবে শাহরিয়ার আলমের এমন মন্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন।
তিনি বলেন, বাঘায় আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম বাবুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কোনো কারণ নেই। উল্টো তিনি নিজেই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে বলেছেন, ‘মনে হচ্ছিল যেন এই লাশটির দরকার ছিল একটি রাজনৈতিক পক্ষের। যেটাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কোনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা যায়।’ এদিকে, এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে ঘিরে শাহরিয়ারের এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ।
ইতোমধ্যে তাকে রাজশাহীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কারের দাবি তোলা হয়েছে। এছাড়াও নেটিজনেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলছেন, ওই দিনকার ঘটনার দায় শাহরিয়ার আলম এমপির এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। ঘটনার দিনের চিত্র কি বলছে? গত ২২ জুন শনিবার বাঘার পৌর মেয়র আক্কাস আলীর অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বাঘা উপজেলা পরিষদের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করে বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগ।
অপরদিকে, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঠিক একই সময়ে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখকদের আধিপত্য বিস্তার, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং দলিল প্রতি অতিরিক্ত ফ্রি আদায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ পালন করেন আক্কাস আলী ও তার সমার্থকরা। কর্মসূচিতে পাল্টা-পাল্টি বক্তব্যের এক পর্যায়ে দুপক্ষ সংর্ঘষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে প্রথমের দিকে বাঘা ভুমি অফিসের সামনে অবস্থান নেয় আক্কাস পক্ষের সমর্থকরা।
এর উল্টো পাশে উপজেলা গেটের সামনে নিহত বাবুলসহ এমপি শাহরিয়ার আলমের সমর্থকরা উপজেলা গেটের সামনে লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্রস্ত্র নিয়ে শক্ত অবস্থান নেন। এর কিছুক্ষণ পরে উপজেলা অডেটিরিয়ামের সামনে থেকে মাথায় গুরুত্বর যখম অবস্থায় বাবুলকে উদ্ধার করে পুলিশ।
কিন্তু ঘটনাস্থলে অনন্য নেতাকর্মীরা থাকলেও বাবুলকে উদ্ধারে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। পরে পুলিশ আহত বাবুলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানায় নেতাকর্মীদের। পরবর্তীতে তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যায়, বাঘা পৌরসভা যুবলীগের সভাপতি শাহিন আলম নিহত বাবুলের প্রতিবেশী এবং বাঘা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি শাহিনুর রহমান পিন্টুর ব্যবসায়ী পার্টনার। ওই সময় গুরুত্বর আহত বাবুল রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে কাতড়াতে থাকলেও তাকে উদ্ধারে এগিয়ে যাননি শাহিন আলমসহ অনন্য নেতাকর্মীরা।
সাদা গেঞ্জি ও মাথায় টুপি পরে সেখানে থাকা দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হচ্ছেন বাঘা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস সরকার। সে বাবুলের ওই সময় পাশে থাকলেও তাকে রক্ষা বা উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, বাবুল হত্যার মূল কারণ হচ্ছে দলিল লেখক সমিতির বিরোধের জের।
তবে এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। তাদের মূল উদেশ্য হচ্ছে রাজনৈতি ফায়দা হাসিলের। এছাড়াও আহত বাবুলকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা বা দেশের বাইরে কেন নেওয়া হল না, স্থানীয় এমপি শাহরিয়ার আলম কেন ব্যবস্থা নিলেন না এ প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে নেতাকর্মীদের মাঝে। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছেন তারা। ওই সুত্রটি আরো বলছে, বাবুল পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন।
তিনি সব সময় এলাকায় চাঁদাবাজি, জুয়া, অবৈধ বালুঘাটসহ নানান অপকর্মে বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তার এমন ভুমিকার জন্য অনেক সময় তাকে নেতাকর্মীরে তোপের মুখে পড়তে হত। সম্প্রতি যুবলীগের সভাপতি শাহিন আলমের অপকর্মের প্রতিবাদ করলে নিহত বাবুলকে নিজ বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে যুবলীগ নেতা শাহিন আলমের কাছ থেকে কোন রকম নিস্তার পান নিহত বাবলু।
এদিকে, নিহত বাবলুকে কোপানোর ঘটনার কিছুক্ষণ পর বাঘা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি শাহিনুর রহমান পিন্টুর ক্যাডের বলে আখ্যায়িত জাহিদ নামে এক যুবক তার নিজ ফেসবুক আক্যাউন্ট থেকে একটি পোস্ট দেয়। সেখানে তিনি লিখেন, ঝামেল মুক্ত সমান, সমান, প্রো.. শেষ, হিসেব সমান সমান। এটা নিয়ম।
আমি শাহরিয়ার ভাইয়ের কর্মী। তার কিছুক্ষণ পরে পোস্টটি ফেসবুক থেকে মুছে ফেলেন জাহিদ। অপরদিকে, ঘটনার পরের দিন ২৩ জুন রোববার দুপুরে বাঘা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি শাহিনুর রহমান পিন্টু ও তার অনুসারীরা হঠাৎ-ই পিন্টুর কক্ষে জড়ো হয়। তারা সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। এরপর কিছুক্ষণ পরই তার এক অনুসারিকে দিয়ে বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে এসে উপস্থিত সকলকে মিষ্টি মুখ করান পিন্টু। তার এমনকর্মকাণ্ডে রহস্যের ডালপালা জন্ম দিয়েছে। ক্ষুদ্ধ হয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নিহত বাবুলের অনুসারী নেতাকর্মীরা।