রাজশাহী টাইমস ডেক্সঃ
এল নিনো হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটি জলবায়ু প্যাটার্ন যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য, সুপেয় পানি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে বলে সতর্ক করেছে বিজ্ঞানীরা৷
ভিডিওঃ ফিরে আসছে মহা প্রলয়ংকারী “এল নিনো” !
টানা তিনবছর ‘লা নিনার’ দাপটের পর গত মাসে ‘এল নিনোর’ আবির্ভাবের কথা নিশ্চিত করেছে বিশ্ব আবহয়াওয়া সংস্থা৷ যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এল নিনো থাকার সম্ভাবনা ৯৫%৷
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত এল নিনোর এই চক্র স্থানীয়ভাবে খরা এবং ক্ষুধার পাশাপাশি প্রাণীবাহিত রোগের সংখ্যাও বাড়ানোর আশঙ্গা রয়েছে৷
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট অ্যান্ড সোসাইটির বিজ্ঞানী ওয়াল্টার ব্যাথগেন বলেন, ‘‘এল নিনোর অর্থ এই নয় যে, বিশ্বব্যাপী এবছরে অন্য বছরের চেয়ে বেশি দুর্যোগ হবে৷” তিনি বলেন, ‘‘এটি বিশ্বের বিভিন্ন অংশে গুরুতর স্থানীয় প্রভাব ফেলতে পারে৷”
উষ্ণায়ন বনাম শীতলীকরণ
‘এল নিনো’ এবং ‘লা নিনা’ হলো ‘এল নিনো-সাউদার্ন অসকিলেশন (ইএনএসও) নামক আবহাওয়ার প্যাটার্নের দুটি অংশ, যা ক্রান্তীয় পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের উপর বাতাসের ধরন এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রার একটি অনিয়মিত কিন্তু পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন৷
‘এল নিনো’ বলতে ইএনএসও-র উষ্ণায়ন পর্যায়কে বোঝায়৷ অন্যদিকে ‘লা নিনা’ বোঝায় এর শীতলকরণ পর্যায়কে৷
‘এল নিনো’-র বছরগুলিতে তাপমাত্রা প্রায় ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়ে থাকে যা ‘লা নিনা’-র সময়ে প্রায় একই পরিমাণে হ্রাস পায়৷ দুই প্যাটার্নের উঠানামার ঘটনাটি প্রায়শই একটি নিরপেক্ষ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায়৷
রেকর্ড তাপমাত্রার সম্ভাবনা
সাম্প্রতিক বছর এবং মাসগুলোতে পৃথিবী বারবার রেকর্ড তাপমাত্রায় পৌঁছেছে৷ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) মতে, জুলাই ২০২৩ এর গড় তাপমাত্রা রেকর্ডের সর্বোচ্চ ছিল, যা ১৯৯১ থেকে ২০২১ সালের জুলাইয়ের গড়ের তুলনায় ০.৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ৷
ডব্লিউএমও-র জলবায়ু পরিষেবার প্রধান ক্রিস হিউইট বলেন, এল নিনোর প্রভাবে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি৷
তিনি মনে করেন, ‘‘তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ আমাদের আভাস দিচ্ছে যে, প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যাওয়ার ৬৬% সম্ভাবনা রয়েছে ৷”
তবে ২০২৪ সালে ‘এল নিনো’র প্রভাব সম্পূর্ণরুপে স্পষ্ট হবে৷ পৃথিবী পরবর্তী অর্ধ দশকে তার উষ্ণতম বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে৷
স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি
বেথগেন বলেন, খরা এবং খাদ্য নিরাপত্তার হুমকির মতো সম্ভাব্য প্রভাবের জন্য আরও ভালভাবে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য জলবায়ু বিজ্ঞানীদের জন্য ‘এল নিনোর’ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ৷
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে এল নিনো ধানের ফসল কাটার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে৷ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ ইতিমধ্যে ফসল মজুদ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ উদাহরণস্বরূপ, ভারত অনেক ধরনের চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে৷ অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার কিছু অংশ দ্রুত ফসল কাটার পরিকল্পনা করছে৷
‘এল নিনো’র কারণে প্রায়ই দক্ষিণ এশিয়ায় বিপজ্জনক তাপপ্রবাহ হয়৷
স্বাস্থ্যের উপর এল নিনোর প্রভাব
এল নিনোর বছরগুলিতে তাপের আকস্মিক পরিবর্তন সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে৷
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান গ্রেগরি ওয়েলেনিয়াস বলেন, ‘‘গত বছর ইউরোপে তাপজনিত কারণে আরও ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য যে কোনও মারাত্মক আবহাওয়ার তুলনায় তাপপ্রবাহে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷”
হঠাৎ উষ্ণ আবহাওয়া মানবদেহকে প্রভাবিত করে এবং কিছু গবেষণায় ‘তাপপ্রবাহ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার’ মধ্যে একটি যোগসাজশ দেখানো হয়েছে৷ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে তাপের কারণে তৈরি সবচেয়ে সাধারণ নেতিবাচক স্বাস্থ্য প্রভাব হলো ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গুর মতো ভেক্টর বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব৷
জলবায়ু প্রভাব ও অভিযোজনের প্রধান মেডেলিন থমসন বলেছেন, ‘‘পূর্ববর্তী এল নিনোর বছরগুলিতে এই ধরনের অনেক প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা গেছে৷ উদাহরণস্বরূপ কেনিয়ায়, ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সালে ‘এল নিনো’র সময়, মশার প্রজনন বৃদ্ধি অসম্ভব বেশি ছিল৷ পূর্ব আফ্রিকায় ব্যাপক ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল৷”
তিনি আরও জানান, ‘‘২০১৫ এবং ২০১৬ সালে শেষ এল নিনোর প্রভাবে সময় একই ধরনের নিদর্শন দেখা গিয়েছিল৷”
তবে এল নিনো সাধারণত ব্যাপক বৈশ্বিক বিপর্যয়ের পরিবর্তে এই ধরনের ভৌগোলিকভাবে স্থানীয় বা আঞ্চলিক ঘটনার মাধ্যমে বেশি প্রকাশ পায়৷