রাজশাহী টাইমস ডেক্সঃ
সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের পোশাক। অথচ শত শত কোটি টাকার এসব রপ্তানি আয়ের দেশে আসেনি একটি টাকাও। পাচার করতে অপরাধীরা আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতির। এখন পর্যন্ত চক্রে জড়িত ৩৩টি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের হদিস মিলেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ৮৩০ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে তথ্য পেয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
মূলত মার্চ, জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে এ অর্থপাচারের কথা জানিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তর। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান ঢাকা, গাজীপুর, সাভার ও চট্টগ্রামে। অপরাধীরা সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে অর্থপাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছেন। চলতি বছর উদ্ঘাটন হলেও এসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত।
সবশেষ সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) রপ্তানির আড়ালে ঢাকা ও গাজীপুরের ১০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের তিন কোটি ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯১৮ মার্কিন ডলার পাচারের কথা জানায় কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ প্রায় তিনশ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- সাভারের প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড, গাজীপুরের পিক্সি নিট ওয়্যারস ও হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড, ঢাকার ফ্যাশন ট্রেড, এম ডি এস ফ্যাশন, থ্রি স্ট্রার ট্রেডিং, ফরচুন ফ্যাশন, অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, স্টাইলজ বিডি লিমিটেড ও ইডেন স্টাইল টেক্স।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি পোশাক পণ্যের চালান বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, এ কারণে পণ্যমূল্য বা বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কাজ শুরু করে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিল অব এক্সপোর্ট ঘেঁটে সংস্থাটি জানতে পারে, তারা জালিয়াতি করে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করেছে।
বিল অব এক্সপোর্টের ২৪ নম্বর কলামে নমুনার কোড ব্যবহার করেছে ২০। এক্ষেত্রে কোনো অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত না হয়ে পুরো রপ্তানিমূল্য বাবদ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। তদন্তকালে ১০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে এক হাজার ২৩৪টি পণ্যচালানে এমন জালিয়াতি করেছে। রপ্তানি সম্পন্ন হওয়া এসব চালানের বিপরীতে পণ্যের পরিমাণ ৯ হাজার ১২১ মেট্রিক টন, যার প্রত্যাবাসনযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার সম্ভাব্য পরিমাণ প্রায় তিনশ কোটি টাকা।
কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রপ্তানি করা পণ্য হলো টি-শার্ট এবং প্রতি পিসের ওজন দেখানো হয়েছে ৫০০/৮০০/১০০০ গ্রাম বা তারও বেশি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতি কেজি নিট ফেব্রিক্স দিয়ে কমপক্ষে তিন থেকে ছয়টি লং স্লিভ টি এল সাইজ টি-শার্ট হয়। এমতাবস্থায় প্রতিটি টি-শার্টের গড় ওজন ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম ধরে রপ্তানি করা টি-শার্টের সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে।
কিছু কিছু পণ্যচালানে রপ্তানিপণ্যের মূল্য খুবই কম ঘোষণা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য রপ্তানিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে সমসাময়িক রপ্তানি চালানের সমজাতীয় পণ্যের মূল্য বিবেচনায়। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বিল অব এক্সপোর্টে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করেছে।
আরও জানা যায়, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পারস্পরিক সহযোগিতা ও যোগসাজশে জাল-জালিয়াতির এ ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠাগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান।
এর আগে গত ২৩ জুলাই কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তর রপ্তানির আড়ালে ১৯ প্রতিষ্ঠানের ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের কথা জানায়। এসব অর্থপাচার হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢাকার ১৭টি এবং চট্টগ্রামের দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পাশাপাশি কাস্টমসের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টগুলো মুদ্রা পাচারের এসব কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। মুদ্রা পাচারে জড়িত ১৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে টোটাল কোয়ালিটি কোম্পানি ১৯টি চালানের মাধ্যমে ২৫৬ টন ২শ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের মূল্য দেখানো হয় এক লাখ ১৫ হাজার ৭শ ডলার। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এসব পণ্যের মূল্য সাত লাখ ৬৮ হাজার ৬শ ডলার।
সেসময় কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বশির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার ১৭ ও চট্টগ্রামের দুই প্রতিষ্ঠান দুবাইয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ১৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা পাচার করেছে বলে প্রমাণ মিলেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানিপণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে দুবাইয়ে পণ্য রপ্তানি করেছে।
এর আগে গত ১৪ মার্চ অধিদপ্তর জানায়, রপ্তানির আড়ালে দেশের চারটি প্রতিষ্ঠান ৩৮২ কোটি টাকা পাচার করেছে। এই চার প্রতিষ্ঠান হলো- এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন, সাবিহা সাইকি ফ্যাশন, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন ও ইলহাম।
প্রতিষ্ঠানগুলো জাল নথি তৈরি করে এক হাজার ৭৮০টি চালানের বিপরীতে ৩৮২ কোটি টাকা পাচার করে। এর মধ্যে এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন পাচার করেছে ২৮২ কোটি, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন ৬২ কোটি, ইলহাম ১৭ কোটি ও ২১ কোটি টাকা পাচার করেছে সাবিহা সাইকি ফ্যাশন।
এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফখরুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ‘লিমাক্স শিপার্স লিমিটেড’র সহযোগিতায় জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি কার্যক্রম করে। অন্য প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করায় এজাতীয় ইএক্সপির কোনো প্রকার কার্যকারিতা না থাকায় বৈধ পন্থায় বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রত্যাবাসিত হওয়ার সুযোগ নেই।
যদিও অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা বরাবরই তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। যেমন এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশনের পরিচালক (অপারেশন্স) মাহমুদ আলম জানান তার প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সাল থেকে বন্ধ। কারা এ কাজ করছে জানা নেই তার।
হংকং ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, জালিয়াতির সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। পাচারের পরিমাণ ও জড়িত কোম্পানির সংখ্যা উভয়ই বাড়তে পারে। ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। আরও অন্তত ২৫টি প্রতিষ্ঠানের ১০ হাজারের বেশি চালান যাচাই-বাছাই চলছে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো ও তাদের সদস্যদের শুদ্ধাচার চর্চায় উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। দেশে অনেক সময়ই অর্থপাচারের ঘটনা উন্মোচন হলেও জড়িত ব্যক্তিরা পরিচয় ও অবস্থানের বলে পার পেয়ে যান। বিত্তশালী, রাজনৈতিক আনুকূল্য বা অন্যভাবে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।
‘পাচারের ঘটনায় যাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উত্থাপিত হলো, তাদের ক্ষেত্রেও এর পুনরাবৃত্তি হবে না, দেশবাসীর এই প্রত্যাশা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে তবে পাচারের জন্য প্রযোজ্য শাস্তির পাশাপাশি পাচার করা অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনা সম্ভব।’