মসজিদে নামাজের জামাতে না গেলে কি গুনাহ হবে?

মসজিদে নামাজের জামাতে না গেলে কি গুনাহ হবে?

ইসলাম

ইসলামীক ডেক্সঃ

প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ ইবাদত। এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতে আদায় করা আবশ্যক। ওজর ছাড়া এ নামাজগুলোর জামাত ত্যাগ করা কাবিরা গুনাহ। কিন্তু কেউ যদি মসজিদে নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ না করে তবে কি তার নামাজ হবে না?

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও জামাত তরক করতেন না। এমনকি অসুস্থ অবস্থায় যখন তিনি হাঁটতে পারতেন না, তখনও দুই সাহাবির কাঁধে ভর করে পা টেনে টেনে নামাজের জামাতে হাজির হয়েছেন। জামাতবিহীন একা একা নামাজ পড়েননি।

জামাতে নামাজ পড়া ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে নামাজ প্রতিষ্ঠায় কাতারবন্দি হয়ে রুকু করার নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে-
وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرَّاكِعِيْنَ
’তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠিত করো, জাকাত আদায় করো এবং রুকুকারীগণের সঙ্গে রুকু করো।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৪৩)

‘হ্যাঁ’ মুয়াজ্জিনের আজান শুনলেই মসজিদে নামাজের জামাতে উপস্থিত হতে হবে। যদি হাদিসে নির্দেশিত কোনো ওজর-আপত্তি না থাকে। ওজর থাকলে ভিন্ন কথা। ওজর না থাকা অবস্থায় মসজিদে না গেলে গুনাহ হবে। কেননা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসের একাধিক বর্ণনায় সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছেন। এতে জামাতে নামাজ পড়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাহলো-
১. হজরত ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের আজান শোনা সত্ত্বেও কোনো ধরনের ওজর ছাড়া (বিনা কারণে) জামাতে নামাজ আদায় থেকে বিরত থাকে; ওই ব্যক্তির (মসজিদে জামাত ছাড়া) অন্যত্র (একাকি) নামাজ (পড়লে) কবুল হবে না। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন- ওজর কি? নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘(বিপদের) ভয়-ভীতি অথবা (কঠিন) অসুস্থতা।’ (আবু দাউদ, বায়হাকি, মুসতাদরাকে হাকেম, দারাকুতনি)

২. নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আজান শোনে অথচ (মসজিদে জামাতে) উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তির কোনো ওজর ছাড়া (ঘরে নামাজ পড়লেও তার) নামাজই হয় না।’ (ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান, মুসতারাকে হাকেম, তারগিব)

৩. নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে কোনো গ্রাম বা মরু-অঞ্চলে তিনজন লোক বাস করলে এবং সেখানে (জামাতে) নামাজ প্রতিষ্ঠা না করা হলে শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব (কর্তৃত্ব) বিস্তার করে ফেলে। সুতরাং তোমরা জামাতবদ্ধ হও। অন্যথায় বকরির পালের মধ্য থেকে নেকড়ে সেই বকরিটিকে ধরে খায়, যে (পাল থেকে) দূরে দূরে থাকে।’ (মুসনাদে আহমাদ)

জামাত প্রসঙ্গে নবিজির কঠোর সতর্কতা
যারা নামাজের জামাতে মসজিদে হাজির হয় না, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। হাদিসে পাকে এসেছে-
৪. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মুনাফিকদের পক্ষে সবচেয়ে ভারী নামাজ হল ইশা ও ফজরের নামাজ। ঐ দুই নামাজের কি মাহাত্ম আছে তা যদি তারা জানতো, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও অবশ্যই তাতে (ইশা ও ফজরের জামাতে) উপস্থিত হতো। আমার ইচ্ছা ছিল যে- কাউকে নামাজের ইকামত দিতে আদেশ দিই, এরপর একজনকে নামাজ পড়তেও হুকুম করি, এরপর এমন একদল লোক সঙ্গে করে নিই; যাদের সঙ্গে থাকবে কাঠের বোঝা। তাদের নিয়ে এমন সম্প্রদায়ের কাছে যাই, যারা নামাজে হাজির হয় না। এরপর তাদের ঘরে মধ্যে রেখেই তাদের ঘরবাড়িকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিই।’ (বুখারি, মুসলিম)

৫. হজরত উসামা বিন যায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘লোকেরা জামাত ত্যাগ করা থেকে অবশ্যই অবশ্যই বিরত হোক, নচেৎ আমি অবশ্যই তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেব।’ (ইবনে মাজাহ, তারগিব)

৬. অন্ধ সাহাবিকেও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জামাতে অনুপস্থিত থেকে ঘরে নামাজ পড়ার অনুমতি দেননি। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার নবিজির দরবারে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মসজিদে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো আমার উপযুক্ত কোনো মানুষ নেই। তাছাড়া মদিনায় প্রচুর হিংস্র প্রাণী (সাপ-বিছা-নেকড়ে প্রভৃতি) রয়েছে। (মসজিদের পথে অন্ধ মানুষের ভয় হয়)। সুতরাং আমার জন্য ঘরে নামাজ পড়ার অনুমতি হবে কি?
আল্লাহর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ওজর শুনে তাঁকে ঘরে নামাজ পড়ার অনুমতি দিলেন। তিনি চলে যেতে উদ্যত হলে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ডেকে বললেন, ‘কিন্তু তুমি কি আজান ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ ও হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ শুনতে পাও।’
তিনি উত্তরে বললেন, ‘জ্বি-হ্যাঁ’
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তাহলে তুমি (মসজিদে) উপস্থিত হও, তোমার জন্য কোনো অনুমতি পাচ্ছি না।’ (মুসলিম, আবু দাউদ)

তিনি আরও বলেন, ‘সেই ব্যক্তির ওপর আল্লাহর অভিশাপ, যে আজান শুনেও জামাতে উপস্থিত হয় না।’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ)

যেসব কারণে জামাতে না গেলে গুনাহ হবে না। তাহলো-
১. অসুস্থতা,
২. হাত-পা কেটে যাওয়া,
৩. অন্ধ হওয়া,
৪. প্যারালাইজড হওয়া,
৫. মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা,
৬. অধিক বৃষ্টি,
৭. রাস্তা কর্দমাক্ত হওয়া,
৮. অতিমাত্রায় শীত পড়া,
৯. ভয়ানক অন্ধকার হওয়া,
১০. সম্পদ ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকা,
১১. মানহানির আশঙ্কা,
১২. প্রাণনাশের ভয় ইত্যাদি।

মনে রাখতে হবে
যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবেলঅর সময়ও জামাত ছেড়ে দেওয়ার হুকুম নেই। মহান আল্লাহ বিধিবদ্ধ করলেন ভয়কালীন সময়ের নামাজ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ اِذَا کُنۡتَ فِیۡهِمۡ فَاَقَمۡتَ لَهُمُ الصَّلٰوۃَ فَلۡتَقُمۡ طَآئِفَۃٌ مِّنۡهُمۡ مَّعَکَ وَ لۡیَاۡخُذُوۡۤا اَسۡلِحَتَهُمۡ ۟ فَاِذَا سَجَدُوۡا فَلۡیَکُوۡنُوۡا مِنۡ وَّرَآئِکُمۡ ۪ وَ لۡتَاۡتِ طَآئِفَۃٌ اُخۡرٰی لَمۡ یُصَلُّوۡا فَلۡیُصَلُّوۡا مَعَکَ وَ لۡیَاۡخُذُوۡا حِذۡرَهُمۡ وَ اَسۡلِحَتَهُمۡ ۚ وَدَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَوۡ تَغۡفُلُوۡنَ عَنۡ اَسۡلِحَتِکُمۡ وَ اَمۡتِعَتِکُمۡ فَیَمِیۡلُوۡنَ عَلَیۡکُمۡ مَّیۡلَۃً وَّاحِدَۃً ؕ وَ لَا جُنَاحَ عَلَیۡکُمۡ اِنۡ کَانَ بِکُمۡ اَذًی مِّنۡ مَّطَرٍ اَوۡ کُنۡتُمۡ مَّرۡضٰۤی اَنۡ تَضَعُوۡۤا اَسۡلِحَتَکُمۡ ۚ وَ خُذُوۡا حِذۡرَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ اَعَدَّ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابًا مُّهِیۡنًا
‘আর যখন তুমি তাদের (যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের) মধ্যে থাকবে। এরপর তাদের জন্য নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, তখন যেন তাদের মধ্য থেকে একদল তোমার সঙ্গে দাঁড়ায় এবং তারা তাদের অস্ত্র ধারণ করে। এরপর যখন সেজদা করে ফেলবে, তখন তারা যেন তোমাদের পেছনে অবস্থান নেয়। আর অপর একটি দল যারা নামাজ আদায় করেনি তারা যেন তোমার সঙ্গে এসে নামাজ আদায় করে এবং তারা যেন তাদের সতর্কতা অবলম্বন ও অস্ত্র ধারণ করে। কাফেররা কামনা করে যদি তোমরা তোমাদের অস্ত্র-শস্ত্র ও আসবাব-পত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও; তাহলে তারা তোমাদের উপর একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর যদি বৃষ্টির কারণে তোমাদের কোনো কষ্ট হয় অথবা তোমরা অসুস্থ হও তাহলে অস্ত্র রেখে দেয়াতে তোমাদের কোনো দোষ নেই। আর তোমরা তোমাদের সতর্কতা অবলম্বন করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করেছেন লাঞ্ছনাদায়ক আজাব।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১০২)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, কোনোভাবেই জামাত থেকে বিরত না থাকা। কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ওজর না থাকলে আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গে জামাতে নামাজ পড়তে মসজিদে উপস্থিত হওয়া।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন সুন্নাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জামাতে নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। সমাজের সর্বস্তরে জামাতে নামাজ বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *